নূর বাহার:
অঙ্গার থেকে পুনরুজ্জীবিত এক ফিনিক্স!
নূর বাহার:
অঙ্গার থেকে পুনরুজ্জীবিত এক ফিনিক্স!
টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের বড়খিল গ্রামের নূর বাহারের যাত্রা অসীম সাহস, অধ্যবসায়, স্থিতিস্থাপকতা এবং জীবন পরিবর্তনের এক দেদীপ্যমান দৃষ্টান্ত। স্বামী মাহাবুব আলম ও ৪৫ বছর বয়সী নূর, সাত সন্তানের এক বৃহৎ পরিবারের ব্যয়ভার করেন– গ্রামের শান্ত পরিবেশে বসবাস করলেও, তাদের জীবন মোটেই সহজ ছিলো না।
মাহাবুব আলম একইসাথে গর্ব এবং দুঃখ নিয়ে তার বাবুর্চি পেশায় থাকা দিনের কথা স্মরণ করেন, "আমি আমার কাজ পছন্দ করতাম, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এরকম একটি বৃহৎ পরিবারের ভরণপোষণ ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছিলো।" ফলত, একরকম বাধ্য হয়েই কক্সবাজার শহর ছেড়ে পরিবারটি তাদের গ্রামে পুনর্বাসিত হয়। নূর বাহারের এক ছেলে স্থানীয় একটি দোকানে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ শুরু করলে, নূর বাহার তার পরিবারকে সাহায্য করার লক্ষ্যে সবজি চাষ করার সিদ্ধান্ত নেন। পরবর্তীতে, দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ নূর, চাষাবাদের উদ্দেশ্যে ৮০ শতাংশ জমি লিজ নেন। তিনি বলেন, "তবে, উন্নতমানের বীজ এবং সঠিক প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অভাবে আমাদের উৎপাদনের হার উল্লেখযোগ্য হারে কমে গিয়েছিলো।"
পরিস্থিতির আরও অবনতি হয় যখন বর্ষাকালে পাহাড়ি ঢলে তাদের কৃষিজমি ভেসে যায় এবং তারা সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েন। তৎসত্ত্বেও, নূর বাহার হাল ছাড়েননি। কৃতজ্ঞতার সুরে তিনি বলেন, "মুক্তি কক্সবাজারের কর্মীরা আমাকে পুনরায় উঠে দাঁড়ানোর জন্য অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন এবং প্রতিনিয়ত সহায়তা করে গেছেন।” তাদের পরামর্শে ও দিক-নির্দেশনায়, নূর বাহার কৃষি কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন উন্নত কৃষি কৌশল গ্রহণ করেছেন এবং দক্ষতা-উন্নয়নের জন্য মুক্তি কক্সবাজারের কর্মীদের নিকট হতে সার্বক্ষণিক পরামর্শ পেয়েছেন। সাহস ও আত্মবিশ্বাসে বলিয়ান নূর তার পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে, শীতকালে মূলা সবজি চাষের উদ্যোগ নেন এবং সে উদ্দেশ্যে ঋণ গ্রহণ করেন।
নূর বাহারের প্রচেষ্টা আক্ষরিক অর্থেই ফলপ্রসূ হয়েছে। কেবল মূলা সবজি উৎপাদন করেই তিনি শুষ্ক মৌসুমে ৭০,০০০ টাকা আয় করেছেন। আশাবাদী স্বরে তিনি উল্লেখ করেন, “কিছু সঞ্চয় দিয়ে, আমি একটি গরু কেনার পরিকল্পনা করেছি।” বর্ণনাতীত কষ্ট সহ্য করার পরেও, নূর বাহার এখন মর্যাদাপূর্ণ এবং স্বনির্ভর জীবনযাপন করছেন। তার উপার্জন দিয়ে তিনি তার সন্তানদের শিক্ষিত করে তুলছেন - তার তিন সন্তান এখন মাদ্রাসায় পড়াশোনা করছে। "আমি চাই তারা সুশিক্ষিত হোক," তিনি গর্বের সাথে বলেন।
দৃঢ় সংকল্প ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে, নূর বাহার তার কমিউনিটির কাছে একজন আদর্শ নারী হয়ে উঠেছেন। "এতো কষ্ট, এতো সংগ্রামে পতিত হওয়া সত্ত্বেও, আমি এখন মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারছি, আমার পরিবারের ভরণপোষণ করতে পারছি এবং একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে পারছি।"
এমন সাহসী মানুষের সহায়তায় এগিয়ে আসতে পেরে মুক্তি কক্সবাজার গর্বিত।
অনুপ্রেরণার অন্য নাম বাল্যবিবাহ প্রতিহতকারী শিফা!
ফাহামিদা ইসলাম শিফা কক্সবাজারের রামু উপজেলার কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের পশ্চিম তিতার পাড়া গ্রামের ১৬ বছর বয়সী এক কিশোরী। সবুজ প্রকৃতি, বন, পাহাড় এবং মেঠো রাস্তায় ঘেরা প্রত্যন্ত এক গ্রামে বেড়ে ওঠে শিফা। যে কমিউনিটিতে শিফা বাস করে, তা এখনো পশ্চাৎপদ ধ্যান-ধারণা আকড়ে পড়ে আছে, যেখানে নারীশিক্ষা এবং বাল্যবিবাহ সম্পর্কে তাদের রয়েছে দৃঢ় অপবিশ্বাস। অধিকাংশ মেয়েই এখানে বাল্যবিবাহের মুখোমুখি হয় এবং নারী-শিক্ষাকে প্রায়শই অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করা হয়। যে সমাজে কন্যা সন্তান জন্মানোকে এখনো অভিশাপ বলে বিশ্বাস করা হয়, এমন একটি সমাজে এক ভাই এবং পাঁচ বোনসহ শিফার বৃহৎ পরিবারের কষ্ট সহজেই অনুমেয়।
শিফা তার সমাজের এই নীচতা ও কূপমন্ডুকতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিল। সে তার বড় বোনদের শিক্ষা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল, পারিপার্শ্বিক চাপে অনন্যোপায় শিফার মা যাদেরকে দ্রুত বিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলো। এবার শিফার পালা! শিফা যখন নবম শ্রেণীতে পড়ে, তখন তার পরিবার দুবাই প্রবাসী একজনকে বিয়ে করার জন্য শিফাকে ক্রমাগত চাপ দিতে শুরু করে। শিফার মা বিশ্বাস করতেন যে শিফা যদি শীঘ্রই বিয়ে না করে, তাহলে কিছুদিন পর তার জন্য উপযুক্ত বর খুঁজে পাওয়া যাবে না, এবং এই অন্ধবিশ্বাসটি তার কমিউনিটির মধ্যে বহুল প্রচলিত।
কিন্তু শিফার স্বপ্ন ছিলো অন্যরকম। সে পড়াশোনা করতে চেয়েছিলো, সে চেয়েছিলো শিক্ষিত হতে এবং তার কমিউনিটির অন্যদের উন্নতির জন্য কাজ করতে। এত অল্প বয়সে বিয়ের কথা শুনে সে উদ্বিগ্ন এবং হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এমনকি, এই বিপদ থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্য কোথায় বা কার কাছে গেলে সাহায্যে পাওয়া যাবে সেটাও শিফা জানতো না। একদিন, একটি গাছের নীচে একাকী বসে থাকাকালীন, সে নিজেকে জিজ্ঞাসা করতে থাকে কিভাবে সে তার বিয়ে থামাতে পারে।
মুক্তি কক্সবাজার পরিচালিত LEAP প্রকল্পের “সিওসি গার্লস গ্রুপ”- এ যোগদানের মাধ্যমে শিফার যাত্রা নতুন মোড় নেয়। LEAP প্রকল্পের মাধ্যমে, শিফা বাল্যবিবাহের ক্ষতিকর প্রভাব, ঋতুকালীন স্বাস্থ্য এবং ব্যক্তিগত বিকাশসহ বিভিন্ন বিষয়ের উপর পরিচালিত ০৮টি অধিবেশনে অংশগ্রহণ করে। এই প্রথমবারের মতো, শিফা জানতে পারে যে নারীদের মাসিক একটি স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া এবং মাসিকের সময় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার গুরুত্বও সে বুঝতে পারে। এই অধিবেশনগুলোতে অংশগ্রহণ করার আগে, তার কমিউনিটির অন্যান্য অনেক মেয়েদের মতো, শিফাও মাসিক-সম্পর্কিত অপতথ্য, অপব্যাখ্যা ও ট্যাবুতে বিশ্বাস করতো। সে জানতোই না যে ঋতুকালীন সময়েও সে তার দৈনন্দিন কাজকর্ম চালিয়ে যেতে পারে, স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে পারে এবং সঠিক স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখার মাধ্যমে সুস্থ থাকতে পারে।
শিফা বাল্যবিবাহের বিপদ এবং এই ক্ষতিকর প্রথা থেকে মেয়েদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য প্রণীত আইন সম্পর্কেও বিস্তারিত জানতে পেরেছে। এইসব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তাকে মতামত প্রকাশের আত্মবিশ্বাস প্রদান করেছে এবং যৌক্তিক বিতর্কে দৃঢ়তার সাথে আত্মপক্ষ সমর্থনের সাহস জুগিয়েছে। মুক্তি কক্সবাজার পরিচালিত LEAP প্রকল্পের “সিওসি গার্লস গ্রুপ”- এ যোগদানের মাধ্যমে শিফা নতুন যা যা শিখেছে তার সবকিছুই সে তার মাকে জানানো সত্ত্বেও তার মা সেসবে কর্ণপাত করেনি, বরং বিয়ের জন্য জোর দিতে থাকে। অগত্যা, অসহায় কিন্তু দৃঢ়প্রতিজ্ঞ শিফা একটি সাহসী পদক্ষেপ নেয় এবং মুক্তি কক্সবাজারের LEAP প্রকল্পের মেন্টর শিমুর সাথে কথা বলার সিদ্ধান্ত নেয়। শিমুর সহায়তায়, তারা স্থানীয় একজন নারী নেত্রীকে নিয়ে আসে, যিনি শিফার বাবা-মাকে বাল্যবিবাহের কুফল এবং আইনি পরিণতি ব্যাখ্যা করেন। সম্ভাব্য জেল এবং জরিমানাসহ বাল্যবিবাহের অন্যান্য ঝুঁকিগুলি বোঝার পর, শিফার বাবা-মা অবশেষে বিয়ে বন্ধ করতে এবং শিফাকে তার পড়াশোনা চালিয়ে যেতে সম্মত হোন।
"পরিবার যখন আমাকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছিলো তখন আমি ভীতসন্ত্রস্ত এবং একাকী বোধ করছিলাম, কিন্তু আমি ভেতরে ভেতরে উপলব্ধি করছিলাম যে আমি জীবন থেকে আরও বেশি কিছু চাই। “সিওসি গার্লস গ্রুপ”- এ যোগদানের পর এক অর্থে আমার চোখ খুলে গেছে, আমি এমনসব অধিকার সম্পর্কে জানতে পেরেছি যেসব সম্পর্কে আগে আমার কোনো ধারণা ই ছিলোনা। ঋতুকালীন স্বাস্থ্য এবং বাল্যবিবাহের ক্ষতি সম্পর্কে জানার ফলে আমি নিজের পক্ষে কথা বলার শক্তি ও আত্মবিশ্বাস অর্জন করেছি। মুক্তি কক্সবাজার এবং মেন্টরের সহায়তায়, আমি আমার বিয়ে বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছি এবং আমার পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছি। আমি আমার সংগ্রামের গল্পটি আমার কমিউনিটির অন্যান্য মেয়েদের সাহায্য করার জন্য ব্যবহার করতে চাই যাতে তারা আমার মতো একই ধরনের বাধার সম্মুখীন না হয়। আমি বিশ্বাস করি প্রতিটি মেয়ের স্বপ্ন দেখার এবং উন্নত জীবনযাপন করার অধিকার রয়েছে।” - ফাহামিদা ইসলাম শিফা
বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে এই জয় শিফার জীবন বদলে দেয়। সে আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে এবং “গার্লস আউট লাউড” প্ল্যাটফর্মে যোগ দেয়, যেখানে সে তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে এবং ঋতুকালীন স্বাস্থ্য, বাল্যবিবাহ এবং জেন্ডার-ভিত্তিক সহিংসতার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে সচেষ্ট হয়। তরুণী ও মায়েদের জন্য, এমনকি স্থানীয় নেতাদের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়গুলি সম্পর্কে শিক্ষিত করার উদ্দেশ্যে শিফা এখন তার কমিউনিটিতে নিয়মিত সেশন ও আলোচনা সভার আয়োজন করে।
শিফার প্রচেষ্টা তার কমিউনিটিতে ফলপ্রসূ পরিবর্তন আনতে শুরু করেছে। বর্তমানে, তার এলাকার বেশিরভাগ নারী এবং মেয়েরা স্বাস্থ্য-সচেতন হয়েছে এবং স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের জন্য নিয়মিত কমিউনিটি ক্লিনিকগুলিতে যান যা আগে চিন্তাও করা যেতো না। মুক্তি কক্সবাজার এবং গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডার অর্থায়নে এবং প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের কারিগরি সহায়তায় বাস্তবায়িত LEAP প্রকল্প আলো ছড়িয়েছে এবং সে আলোয় আলোকিত কিশোরী শিফা অজ্ঞানতার অন্ধকার দূর করে তার কমিউনিটির হিতার্থে কাজ করে যাচ্ছে। সে কেবল তার সুন্দর ভবিষ্যত গঠন করছে এমনটি নয়, বরং একইসাথে নিশ্চিত করছে যে তার কমিউনিটির অন্য কোনো মেয়েকে যেনো তার মতো সংগ্রামের সম্মুখীন হতে না হয়।
শিফার গল্প অসীম সাহস, স্থিতিস্থাপকতা এবং নিজের এবং অন্যদের জন্য একটি উন্নত পৃথিবী তৈরির দৃঢ় সংকল্পের গল্প। শিক্ষা এবং সচেতনতার মাধ্যমে, তিনি প্রমাণ করেছেন যে গভীরভাবে প্রোথিত অন্ধবিশ্বাসের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও ইতিবাচক পরিবর্তন সম্ভব। শিফা তার শিক্ষা চালিয়ে যাওয়ার এবং তার দেশের কল্যাণের জন্য কাজ করার স্বপ্ন দেখে। তার কমিউনিটির সহায়তায়, সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার পথে এগিয়ে চলেছে সে।