সাফল্য গাঁথা
সাফল্য গাঁথা
আলোয় ভুবন ভরা!
কক্সবাজারের ঈদগাঁও উপজেলায় বসবাসকারী সত্তরোর্ধ্ব নারী ফরমুজা বেগম দারিদ্র্যের কারণে সৃষ্ট অবর্ণনীয় দুর্দশা কাটিয়ে উঠেছেন। দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে এই বিজয় তাকে অধ্যবসায়ের এক উজ্জ্বল প্রতীক হিসেবে পরিচিত করেছে। দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করায়, ফরমুজা বেগমকে তার বাবা-মা তাকে খুব অল্প বয়সেই বিয়ে দিয়ে দেন।
ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, বিয়ের পরেও দারিদ্র্যের তীব্র থাবা থেকে সে মুক্তি পায়নি কারণ তার দিনমজুর স্বামী মোঃ কালু মিয়া প্রায়শই কোন না কোন অসুস্থতায় ভুগতো। অসুস্থতার দরুন বেশিরভাগ সময় তিনি কর্মহীন থাকতেন। ফলে, কাজের অভাবে তাদের দৈনন্দিন আয় ও পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, যার ফলে চরম অপুষ্টির স্বীকার হয় তারা। অবশেষে, ফরমুজা বেগম নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়েন। দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ থাকার কারণে তার চোখের সমস্যা দেখা দেয় যা দিন দিন আরও খারাপ হতে থাকে এবং তা পরিবারে অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। দৃষ্টিশক্তির সমস্যায় ফরমুজা দৈনন্দিন কাজকর্ম ঠিকমতো করতে পারতেন না বলে এক পর্যায়ে, তার স্বামী তাকে তালাক দিয়ে দেন। বিবাহবিচ্ছেদের পর ফরমুজা বেগম তার পৈতৃক বাসায় ফিরে আসতে বাধ্য হন।
মুক্তি কক্সবাজার কর্তৃক বাস্তবায়িত এবং মুক্তি কক্সবাজার ও পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)-এর যৌথ অর্থায়নে পরিচালিত “সমৃদ্ধি কর্মসূচি”র স্বাস্থ্য-পরিদর্শক একদিন বাড়ি পরিদর্শন করার সময় ফরমুজা বেগমের কথা জানতে পারেন। তার কষ্টের গল্প শোনার পর, উক্ত স্বাস্থ্য-পরিদর্শক তাকে প্রকল্পের সুবিধাদি সম্পর্কে অবহিত করেন এবং তাকে একটি স্বাস্থ্য-কার্ড প্রদান করেন। পরবর্তীতে “সমৃদ্ধি কর্মসূচি” একটি চক্ষু চিকিৎসা ক্যাম্পের আয়োজন করলে, ফরমুজা বেগম সেখানে ডাক্তার দেখাতে আসেন। পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা-নিরিক্ষার পর, তার উভয় চোখেই ছানি ধরা পড়ে। চক্ষু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুসারে, প্রকল্প কর্মী তাকে কক্সবাজার বায়তুশ শরফ হাসপাতালে নিয়ে যান এবং একই দিনে তার চোখের অস্ত্রোপচার করা হয়। নির্ধারিত ওষুধ সেবনের ফলে তিনি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন। তিনি বলেন,
"চোখ খোলার পর আমি প্রথমেই যা দেখতে চেয়েছিলাম তা হল মুক্তি কক্সবাজারের সেসকল কর্মীদের যারা আমার জীবনে আলোকবর্তিকা হয়ে এসেছে।"
ফরমুজা বেগমের দৃষ্টি-শক্তি ফিরে আসায় তিনি এখন স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি এখন স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। “সমৃদ্ধি কর্মসূচি”র পরামর্শ অনুসারে, তিনি এখন সবজি চাষ করেন এবং বাড়ীর উঠানে মুরগি পালন করেন। তার দৈনন্দিন চাহিদা পূরণের পাশাপাশি, তিনি উদ্বৃত্ত শাকসবজি এবং মুরগি বিক্রি করে অর্থও উপার্জন করতে পারেন। ফরমুজা বেগম তার পৈতৃক বাড়িতে আগের চেয়েও সুখী জীবনযাপন করছে। বিপদাপন্ন এমনসব মানুষের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও দোয়া মুক্তি কক্সবাজারকে শত বাধা স্বত্তেও তার উন্নয়ন এবং মানবিক কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে অনুপ্রাণিত করে।
স্বপ্ন আকাশ ছোঁয়ার!
"COTE স্কুল আমাকে পড়তে এবং লিখতে শিখিয়েছে।
আমি একজন ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখি।"
- সাদিয়া বিবি
সাদিয়া বিবি, ২০১৩ সালে মায়ানমারের মন্ড কিয়াংমং পাড়ায় জন্মগ্রহণকারী একজন তরুণী যে এখন বাংলাদেশে অবস্থিত রোহিঙ্গা ক্যাম্প-২ডব্লিউ-তে বসবাস করে। ক্যাম্পের জনাকীর্ণ পরিবেশে বসেও আম, কাঁঠাল, পেয়ারা এবং নারকেল বাগানে ঘেরা তার গ্রামের বাড়ীর কথা মনে করে সাদিয়া, মনে করে সবুজে আচ্ছাদিত তাদের শান্তিপূর্ণ দোতলা কাঠের ঘরকে। বাবার সাথে মাছ ধরা এবং তার চাচাতো ভাইবোনদের সাথে খেলা-ধুলা করেই তার শৈশব কেটেছে। কোনোকিছুর অপ্রতুলতা ছিলনা তার।
কিন্তু সেই সুখের দিনগুলি বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। একদিন মায়ানমার সেনাবাহিনী এবং উত্তেজিত রাখাইনের জনতা অতর্কিতে তাদের গ্রামে আক্রমণ করে। সাদিয়া খুব অল্প বয়সে সহিংসতা প্রত্যক্ষ করেছে। সে দেখেছে কিভাবে সৈন্যরা কিশোরী মেয়েদেরকে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে যেত এবং তাদের উপর নির্যাতন করত। শুধু মেয়েদের ই নয়, ছেলেদেরও তুলে নিয়ে যাওয়া হতো, হত্যা করা হতো, বিকৃত করা হতো তাদের লাশ। এমন ও হতো যে, জোরপূর্বক উঠিয়ে নেয়া ছেলেদের আর কখনো খুজেই পাওয়া যেতো না। সাদিয়ার খালা উনার মেয়েদেরকে লুকিয়ে রাখতেন যাতে সেনাবাহিনী তাদের খুঁজে না পায়। একদিন, মায়ানমার সেনাবাহিনী এবং রাখাইন জনতা তাদের গ্রামের অনেক বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। সাদিয়ার পরিবার তখন বাধ্য হয়ে পালিয়ে যায়। পালিয়ে আসার সময় তারা দেখে রাস্তায় অগনিত মৃতদেহ, যেখানে ছোট ছোট বাচ্চাদের মৃতদেহও ছিল। ক্ষুধার জ্বালায় সাদিয়া কেঁদে উঠলে, তার মা-বাবা তাকে প্রবোধ দেয় - কিন্তু তাদের কাছে খাবার মত কিছুই ছিল না। দুর্বিষহ ও বেদনাদায়ক এক যাত্রার পর, তার পরিবার বাংলাদেশে পৌছায়।
পরে সাদিয়াকে মুক্তি কক্সবাজার কর্তৃক বাস্তবায়িত Children on the Edge (COTE) স্কুলে ভর্তি করা হয় যা এক অর্থে তার জীবন বদলে দেয়। এই প্রথমবারের মতো, সাদিয়া নিরাপদ বোধ করে। COTE স্কুলের বন্ধুত্বপূর্ণ শিক্ষার পরিবেশ তাকে তার অতীতের ভয়াবহ মানসিক যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতা থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করেছে। সাদিয়া এখন মুক্তি কক্সবাজার পরিচালিত COTE স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে এবং বার্মিজ, ইংরেজি, হানিফি, ও গণিতের মতো বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করেছে। সাদিয়া বলে,
"COTE স্কুল আমাকে পড়তে এবং লিখতে শিখিয়েছে।
আমি একজন ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখি।"
সাদিয়ার এখন অনেক স্বপ্ন। সে একজন ডাক্তার হতে চায় যাতে সে অন্যদের সাহায্য করতে পারে, বিশেষ করে যারা অসুস্থ হওয়ার পর তার মতো কষ্ট পায়। আশাবাদী একটি নতুন জীবনের স্বপ্ন বুননে সাহায্য করার জন্য সাদিয়া মুক্তি কক্সবাজার এর প্রতি গভীর কৃতজ্ঞ।
আত্মবিশ্বাসের হাসি!
মুর্শিদা বেগম কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার মোহাম্মদ শাহঘোনায় বাস করেন। তার জীবন কখনোই সুখকর ছিল না। যদিও খুব অল্প বয়সে তার বিয়ে হয়েছিল, কিন্তু তার প্রথম বিয়েটি টিকেনি। অতঃপর, তালাব আলী নামে একজন জেলেকে বিয়ে করেন তিনি, তালাব আলী পূর্বে একটি বিয়ে করেছিলেন এবং সেই সংসারে তার চারটি সন্তান ছিল। পরবর্তীতে, তাদের আরও তিনটি সন্তান জন্মগ্রহন করলে, নয়জন সদস্য নিয়ে মুর্শিদার পরিবারটি একটি বৃহৎ পরিবারে পরিনত হয়! তালাব আলী এতই বয়োবৃদ্ধ এবং দরিদ্র ছিলেন যে, তিনি নিয়মিত মাছও ধরতে পারতেন না, এর ফলে তার পরিবারের পক্ষে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছিল। পর্যাপ্ত খাবার না থাকায়, পরিবারের বেশিরভাগ সদস্য প্রচণ্ড রকমের অপুষ্টিতে ভুগছিল।
২০২৪ সালের মার্চ মাসে, তালাব আলী Fisheries Livelihood Enhancement Project (FiLEP) প্রকল্পের একজন উপকারভোগী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হলে পরিস্থিতির পরিবর্তন শুরু হয়। FiLEP এমন একটি প্রকল্প যা প্রাকৃতিক ও আর্থসামাজিক বিভিন্ন কারনে বিপর্যস্ত জেলে পরিবারকে তাদের জীবিকা এবং দৈনন্দিন পুষ্টিমান নিশ্চিত ও উন্নত করতে সহায়তা করে। FiLEP মুর্শিদাকে নতুন দক্ষতা অর্জনের সুযোগ করে দিয়েছে। তিনি ছাগল ও মুরগি পালন, মৎস্য সম্পদ ব্যবস্থাপনাসহ অন্যান্য বেশ কয়েকটি প্রশিক্ষণ অধিবেশনে যোগদান করেন যেখানে তিনি চাষাবাদের পাশাপাশি মা ও শিশুর পুষ্টি, খাদ্য-বৈচিত্র্যর গুরুত্ব, পরিষ্কার-পরিচ্ছন জীবনযাপন, এবং স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারেন।
নিয়মিত পুষ্টি-বিষয়ক অধিবেশনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে, মুর্শিদা বুঝতে পারেন যে পুষ্টিকর খাবার এবং সঠিক যত্ন সুস্থতার অন্যতম নিয়ামক। তার বাচ্চাদের শারিরিক ও মানসিক বৃদ্ধি সঠিকভাবে হচ্ছে কিনা, প্রকল্প থেকে তা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা হয়, এবং পুষ্টি-সহায়তা অধিবেশনে থেকে প্রাপ্ত পরামর্শের বাস্তব প্রতিফলন মুর্শিদা দেখতে পান। ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও অপুষ্টির বিরুদ্ধে মুর্শিদা বেগমের এই লড়াইয়ে, সহায়তা হিসেবে FiLEP টেকসই, শক্তিশালী, কার্যকর ইনপুট সহায়তাও করে। সেসব ইনপুট সহায়তা দিয়ে, মুর্শিদা তার বাড়ির উঠোনকে একটি সমৃদ্ধ সবজি খামারে পরিণত করেছেন। প্রকল্পের দিক-নির্দেশনা এবং সরবরাহকৃত সরঞ্জামাদির সাহায্যে, তিনি কেবল তার খাদ্যই উৎপাদন করেননি - তিনি বৃদ্ধি করেছেন তার আত্মবিশ্বাস। মুর্শিদা বেগমের চাষকৃত সবজি-বাগানে সবজির ফলন এত ভালো হয় যে, পরিবারের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে সে অতিরিক্ত সবজি বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করতে সক্ষম হয়।
পরবর্তীতে, তার বর্ধিত আয়ের মাধ্যমে, মুর্শিদা একটি সাহসী পদক্ষেপ নেয়: কেবল পারিবারিক চাহিদা মেটানোতে আবদ্ধ না থেকে তিনি গৃহস্থালি বাগানের বাইরেও তার প্রচেষ্টা প্রসারিত করেন এবং পান চাষের জন্য জমি লিজ নেন। FiLEP প্রকল্পের অব্যাহত কারিগরি ও প্রযুক্তিগত সহায়তায়, তিনি পরবর্তীতে আরও বিভিন্ন ধরণের সবজি তার চাষের আওতায় নিয়ে আসেন, যা তার পরিবারের জন্য বছরব্যাপী খাদ্য এবং আয়ের উৎস তৈরি করে। আজ, মুর্শিদা গর্বের সাথে তার পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব পালন করেন। তার ভাষ্যমতে,
“মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন আমরা অনাহারে থাকতাম, কিন্তু এই বছর আমি তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করিনি। আমি নিজেই সবজি চাষ করি, আর উদ্বৃত্ত সবজি বিক্রি করে পাওয়া টাকা দিয়ে আমার মেয়ের স্কুলের ফি দেই।”
এখন, মুর্শিদার স্বাস্থ্য এবং খাদ্যাভ্যাসের প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে। তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছেন পুষ্টিমান নিশ্চিতকরণে খাদ্য-বৈচিত্র্যর গুরুত্ব, সর্বোপরি, তিনি একজন আত্মবিশ্বাসী মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সঠিক প্রশিক্ষণ কীভাবে জীবন বদলে দিতে পারে, তার একটি শক্তিশালী উদাহরণ মুর্শিদার গল্প। FiLEP-এর সাহায্যে, তিনি কেবল বেঁচে থাকার উপায়ই খুঁজে পাননি - তিনি তার পরিবারকে সুস্থ, সুন্দর একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন । FiLEP প্রকল্প বাস্তবায়নে অংশীদার হতে পেরে মুক্তি কক্সবাজার গর্বিত।